বাকখালি নদীর চরে একের পর এক উঠছে দালান

কোহিনূর হায়াত।

কক্সবাজার শহরে বাঁকখালী নদীর পাড়ে ব্যাপক দখলবাজি চলছে। সরকারি নানা নিষেধাজ্ঞার পরও রাতে–দিনে প্রতিনিয়ত ভরাট করে দখল করা হচ্ছে নদী। জমি দখল করতে ইতিপূর্বে সাবাড় করা হয়েছে প্যারাবনের কয়েক লাখ গাছ। নদী দখল ও ভরাট করে রাতারাতি গড়ে তোলা হচ্ছে পাকা ও বহুতল দালান। শহরের নুনিয়ারছড়া এবং ফিশারি ঘাট থেকে টেকপাড়া হয়ে গোদার পাড়া অংশ পর্যন্ত বেপরোয়াভাবে নদী ভরাট করে দখলযজ্ঞ চলছে।

জেলা প্রশাসন বলছে, সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে বাঁকখালী নদীর দখল হওয়া পুরো জমি উদ্ধারে জরিপ এবং প্রয়োজনীয় কাজ চলছে। তবে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ না থাকায় প্রতিমুহূর্তে দখল হচ্ছে এই জনগুরুত্বপূর্ণ নদীর বিভিন্ন অংশ। এতে পরিবেশ ও প্রতিবেশ চরম হুমকির মুখে পড়েছে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ড্রেজার মেশিনসহ বিভিন্নভাবে বালু উত্তোলন করে প্রতিনিয়ত এই নদীর প্রবাহমান স্থানে বালু ভরাট করে দখল করা হচ্ছে। ইতিপূর্বে কস্তুরাঘাট থেকে গোদার পাড়া পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকা দখল করে সেখানে উঠেছে বড় বড় দালান। এছাড়া নতুন করে ভরাট হচ্ছে আরো বহুস্থান এবং তৈরি করা হচ্ছে নতুন নতুন দালান। নদীর জমিতে স্কুলসহ বিভিন্ন শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে–যাতে দখল পাকাপোক্ত করা যায়। এতে প্রবাহমান নদীর জমি এখন রূপ নিয়েছে পাড়া–মহল্লায়। অন্যদিকে দু’বছর আগে উচ্ছেদ করা কস্তুরাঘাট এলাকার বিস্তীর্ণ এলাকায় আবারো পুরোপুরি পাকা দালানসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করেছে দখলবাজরা।

অনুসন্ধানে স্থানীয়রা জানিয়েছেন, নামে–বেনামে বিভিন্ন খতিয়ানের জমি দেখিয়ে বহু সিন্ডিকেট বাঁকখালী নদীর জমি বিক্রি করছে। প্রশাসনকে ঠেকাতে একাধিক মামলাও করে রেখেছে সিন্ডিকেটগুলো। মূলত বিভিন্ন ভুয়া খতিয়ান দেখিয়ে উক্ত প্রতারক চক্র মানুষকে বোকা বানিয়ে সরকারি নদীর জমি বিক্রি করছে।

স্থানীয় বড়বাজার এলাকার জসিম উদ্দিন, টেকপাড়ার আবুল কালাম, ৬নং এলাকার ফরিদুল আলমসহ অনেকে বলেন, ‘কক্সবাজার শহরের ব্যবসা বাণিজ্যসহ প্রাণ প্রবাহের অন্যতম উপাদান হচ্ছে বাঁকখালী নদী। বহু আগে দখলদারদের তালিকা প্রকাশ হলেও কোনো আইনগত ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। এতে বেপরোয়া হয়ে আরো জোরেসোরে নদীর জমি দখল করা হচ্ছে।’

চট্রলার কন্ঠকে পেশকার পাড়ার বাসিন্দা নুরুল আবছার বলেন, ‘আমার বয়স প্রায় ৪৫ বছর। আগে আমাদের বাড়ির পাশেই আসতো বাকঁখালী নদীর পানি। কিন্তু সময়ের আবর্তে এখন নদীর পানি এক দেড় কিলোমিটার দূরে চলে গেছে। তবে এখনো নদীর জোয়ারের পানি আসে এবং নৌকা এখনো বাঁধা থাকে। কিন্তু সেখানেও পিলার দেওয়া আছে। বলা হচ্ছে এগুলো নাকি ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি।’

স্থানীয় বাসিন্দা আইনজীবী মোহাম্মদ আবদুল্লাহ বলেন, ‘আওয়ামী লীগ আমলে নেতাদের প্রভাব খাটিয়ে বিস্তীর্ণ প্যারাবন কেটে নদী দখল করা হয়েছে। এ নদী দখলকারীদের অন্যতম হাতিয়ার আদালতের নিষেধাজ্ঞা। প্রশ্ন হচ্ছে– যদি জমির মালিকানা সঠিক থাকে তাহলে কেন আদালতের নিষেধাজ্ঞা নিতে হবে। এতে বুঝা যায় কাগজপত্রগুলো সব ভুয়া।’ নুনিয়ারছড়া হতে টেকপাড়া পর্যন্ত বাঁকখালী নদী দখলে জড়িত ১৩০ জনের একটি নাম প্রকাশ করেছিল পরিবেশ অধিদপ্তর। কস্তুরাঘাট এলাকায় বিস্তীর্ণ প্যারাবন কেড়ে সাবাড় করার ঘটনায় একাধিক মামলা হয়েছে। কিন্তু এই পর্যন্ত কোনো আইনগত ব্যবস্থা নেয়নি পরিবেশ অধিদপ্তর। মামলাগুলো আছে লালফিতায় বন্দি। প্রকাশ্যে দিন–দুপুরে প্যারাবন কেটে দখল করলেও নিশ্চুপ রয়েছে অধিদপ্তর ।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক জিল্লুর রহমান বলেন, ‘কারা দখল করছে সেটা আমাদের দেখার বিষয় নয়। আমাদের দেখার এখতিয়ার পরিবেশ ও প্রতিবেশ ক্ষতি হচ্ছে কিনা। এছাড়া ব্যক্তি মালিকাধীন জমি হলেও আমাদের করার কিছু থাকে না।’

এদিকে দখলবাজি রোধ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন স্থানীয় পরিবেশবাদীরা। পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ প্রতিনিয়ত প্রশাসনকে চাপ সৃষ্টি করছে। গত মঙ্গলবার দখলবাজদের উচ্ছেদ করতে জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছেন পরিবেশবাদী সংগঠন ‘বাপা’র নেতৃবৃন্দ।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি–বেলা’র প্রতিনিধি পরিবেশকর্মী ইব্রাহিম খলিল মামুন বলেন, ‘বাঁকখালী নদী দখল ঠেকাতে বেলার রিট রয়েছে। এছাড়া সংশ্লিষ্টদের একাধিক লিগ্যাল নোটিশও দেয়া হয়েছে। তারপরও কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।’

চট্রলার কণ্ঠকে ফোনআলাপে সুশাসনের জন্য নাগরিক–সুজন’র জেলা সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘সপ্তাহখানে আগে নির্বিচারে প্যারাবন কেটে নদী দখল সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ তোলপাড় সৃষ্টি হয়। এর প্রেক্ষিতে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।’

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে চট্রলার কণ্ঠকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নীলুফা ইয়াছমিন চৌধুরী বলেন, ‘ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পর পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, নদীর জমি দখল করে দালান তৈরি করা হচ্ছে। আমরা আর কাউকেই নদীর জমি দখল করতে দেবো না। এই বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হবে। দখল করলে সাথে সাথে উচ্ছেদ ও আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. নিজাম উদ্দীন চট্রলার কণ্ঠকে বলেন, ‘উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশনা অনুসারে নদীর জমি উদ্ধারে একটি জরিপ প্রক্রিয়া চলছে। অন্যদিকে দখলবাজির অভিযোগে সমপ্রতি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। কেউ নদী দখলে করলে উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn

সর্বশেষ খবর

সাম্প্রতিক