এক দশকের প্রতীক্ষা শেষে বাস্তবায়নের পথে চট্টগ্রাম বন্দরের বে টার্মিনাল প্রকল্প

ইমরান নাজির, চট্রলার কন্ঠ।

এক যুগের বেশি সময় ধরে নানাবিধ প্রশাসনিক, আর্থিক ও কারিগরি জটিলতায় থমকে থাকা চট্টগ্রাম বন্দরের বহুল প্রতীক্ষিত বে টার্মিনাল প্রকল্প অবশেষে বাস্তবায়নের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে। আগামী ২০ এপ্রিল জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রকল্পটি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হচ্ছে। এর মধ্যেই সম্পন্ন হয়েছে প্রাক–একনেক (প্রি–একনেক) কার্যক্রম।

প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন পেলেই বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার (৬৫০ মিলিয়ন ডলার) ঋণচুক্তি সম্পাদিত হবে। এরপরই শুরু হবে দেশের অন্যতম বৃহৎ ও সম্ভাবনাময় এই অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের পূর্ণমাত্রায় বাস্তবায়ন।

চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নয়ন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে হালিশহর উপকূলজুড়ে আধুনিকতম ও দীর্ঘমেয়াদী বন্দর সুবিধা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ২০১৩ সালে প্রথম প্রস্তাব আকারে যাত্রা শুরু করে বে টার্মিনাল প্রকল্প। পরিকল্পনা অনুযায়ী, এই টার্মিনাল গড়ে উঠবে আগামী একশ বছর ধরে দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর হিসেবে ব্যবহারের উপযোগিতা বিবেচনায়।

কিন্তু ভূমি অধিগ্রহণ, অর্থায়ন, কারিগরি নকশা এবং প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার জটিলতায় প্রকল্পটি বারবার থেমে যায়। ফলে ব্যবহারকারীদের মধ্যে হতাশা জন্ম নেয়। অবশেষে নানা চেষ্টার পর বন্দর কর্তৃপক্ষ পৃথক তিনটি কাজকে একত্র করে একক বৃহৎ প্রকল্প হিসেবে ‘বে টার্মিনাল মেরিন ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট’ (বিটিএমআইডিপি) গ্রহণ করে।

প্রকল্পের আওতায় রয়েছে – সমুদ্র চ্যানেল খনন, বৃহৎ ব্রেকওয়াটার নির্মাণ, মাল্টিপারপাস ও কন্টেইনার টার্মিনাল নির্মাণ, রেল ও সড়ক সংযোগ, নেভিগেশন সহায়ক যন্ত্র স্থাপনসহ আধুনিক নৌ অবকাঠামো নির্মাণ। পুরো প্রকল্পের প্রস্তাবিত ব্যয় ধরা হয়েছে ১৪ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংক দেবে ১০ হাজার ২৭২ কোটি ৪০ লাখ টাকা। বাকি অর্থ ৪ হাজার ৬৩৬ কোটি ৪৩ লাখ টাকা যোগান দেবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ।

বন্দর সচিব মোহাম্মদ ওমর ফারুক চট্রলার কণ্ঠকে জানান, প্রি–একনেক কার্যক্রম ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, ২০ এপ্রিল অনুষ্ঠেয় একনেক সভায় প্রকল্পটি চূড়ান্ত অনুমোদন পাবে। অনুমোদনের পরপরই ঋণচুক্তি সম্পন্ন করে কাজ শুরু করা হবে।

প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, হালিশহর থেকে দক্ষিণ কাট্টলীর রাসমনি ঘাট পর্যন্ত সাড়ে ছয় কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত হবে বে টার্মিনাল। প্রায় ৯৩৯ একর মূল ভূমির সঙ্গে সমুদ্রভূমি ভরাট করে আরও প্রায় আড়াই হাজার একর জায়গায় গড়ে তোলা হবে টার্মিনালের অবকাঠামো। দেশের ইতিহাসে এটিই হবে প্রথম বৃহৎ ব্রেকওয়াটার নির্মাণ।

প্রকল্পটির তিনটি পৃথক টার্মিনালের মধ্যে দুটি কন্টেইনার টার্মিনাল নির্মাণ করবে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান – সিঙ্গাপুরভিত্তিক পিএসএ ও দুবাইভিত্তিক ডিপি ওয়ার্ল্ড। এ দুটি টার্মিনালে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০০ মিলিয়ন ডলার। তৃতীয়টি হবে মাল্টিপারপাস টার্মিনাল, যার জন্য দেশি বা বিদেশি যৌথ বিনিয়োগে নতুন করে দরপত্র আহ্বান করা হবে।

ব্রেকওয়াটার নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৮ হাজার ২৬৯ কোটি ৮৫ লাখ টাকা, নেভিগেশন চ্যানেল খননে ১ হাজার ৯৭৯ কোটি ৪৫ লাখ টাকা, নেভিগেশনে সহায়ক যন্ত্র স্থাপনে ৫৭ কোটি ৭০ লাখ টাকা এবং রেল ও সড়ক সংযোগ স্থাপনে ৩ হাজার ৪৩৪ কোটি ৬৮ লাখ টাকা।

জানতে চাইলে চট্রলার কন্ঠকে বন্দর সচিব জানান, একনেক অনুমোদনের পর ব্রেকওয়াটার ও নেভিগেশন চ্যানেল খননের কাজই প্রথম শুরু হবে। এরপর ধাপে ধাপে শুরু হবে টার্মিনাল নির্মাণ। পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০২৮ সালের মধ্যে চ্যানেল ও ব্রেকওয়াটার নির্মাণ শেষ হবে এবং ২০৩১ সালের মধ্যে টার্মিনাল চালু করে সেখানে জাহাজ নোঙর করানো সম্ভব হবে।

প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে দেশের বাণিজ্যিক প্রবাহে বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বর্তমানে জোয়ার–ভাটার ওপর নির্ভর করে দিনের চার ঘণ্টা জাহাজ চলাচল করতে পারে চট্টগ্রাম বন্দরে। সেখানে বে টার্মিনালে রাত–দিন ২৪ ঘণ্টা জাহাজ চলাচল করতে পারবে। এখন সর্বোচ্চ ৯.৫ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভেড়ানো গেলেও নতুন টার্মিনালে ১২ মিটার ড্রাফটের চার থেকে পাঁচ হাজার টিইইউএস কন্টেইনারবাহী বড় জাহাজ ভেড়ানো যাবে। এতে বন্দরের সক্ষমতা তিনগুণ বেড়ে যাবে।

প্রসঙ্গত, প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয় ২০১৩ সালে। পরের বছর জমি বরাদ্দের জন্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) ছাড়পত্র পেতে সময় লাগে দেড় বছর। ২০১৭ সালে মাত্র ৬৭ একর জমি অধিগ্রহণ সম্ভব হয়। পরে আরও ৫০০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। বর্তমানে প্রকল্পটি আরও ৩০০ একর জমির অপেক্ষায় রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন, একনেকে অনুমোদনের পর এই জমি সংকটও কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn

সর্বশেষ খবর

সাম্প্রতিক