নিজস্ব প্রতিবেদক।
বাংলা বর্ষবরণের অন্যতম আয়োজন ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামটি এবারের আয়োজনে থাকছে না। এই শোভাযাত্রার নতুন নাম হবে ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’। শুক্রবার (১১ এপ্রিল) সকাল ১১টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে এক সংবাদ সম্মেলনে এ নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত জানানো হয়।
চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মো. আজহারুল ইসলাম শেখ জানান, এবার শোভাযাত্রার নাম হচ্ছে ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’।
এ প্রসঙ্গে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘নাম পরিবর্তনের বিষয়ে আমি পরিবর্তন বলতে চাই না। শুরুতে বর্ষবরণ ছিল আনন্দ শোভাযাত্রা। আগে যেভাবে হয়েছিলো সেটির স্বতঃস্ফূর্ততা কতোখানি ছিল সেটা বিশ্লেষণের বিষয়। পরবর্তীতে মঙ্গল শোভাযাত্রার ক্ষেত্রে কী ঘটেছে এজন্য পরিবর্তন নয়, পুনরুদ্ধার বলছি আনন্দ শোভাযাত্রাকে।’
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, অন্যান্য বছরের চেয়ে এ বছরের শোভাযাত্রাটি হবে ‘সর্ববৃহৎ, অন্তর্ভুক্তিমূলক,বর্ণাঢ্য ও জাঁকজমকপূর্ণ’। শোভাযাত্রায় বৈচিত্র্য ও বিভিন্ন জাতিসত্তার অংশগ্রহণ থাকবে।
চারুকলা অনুষদের ডিন জানান, এবারের ‘নববর্ষের ঐকতান, ফ্যাসিবাদের অবসান’ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে শোভাযাত্রায় অংশ নেবে বাংলাদেশে থাকা ২৮টি জনগোষ্ঠী।
সবার অংশগ্রহণের মধ্য শোভাযাত্রাটি ‘সকলের হয়ে উঠবে’ বলে মনে করছেন আয়োজন সংশ্লিষ্টরা।
এবারে নববর্ষের শোভাযাত্রা প্রস্তুতির শুরু থেকেই ইসলামী আন্দোলনসহ বিভিন্ন দল ও সংগঠন মঙ্গল শোভাযাত্রা নামটি নিয়ে আপত্তি জানিয়ে আসছিলো। শোভাযাত্রার এই নাম পরিবর্তনের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিলো তখন থেকেই। অবশেষে নতুন বছর শুরুর তিন দিন আগে এই নাম পরিবর্তনের বিষয়ে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এলো।
এ বিষয়ে চারুকলা অনুষদের ডিন ড. মো. আজহারুল ইসলাম শেখ সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘গেলো সময়ে মঙ্গল শব্দটিকে এমনভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, এটা নিয়ে যথেষ্ট খারাপ অনুভূতি কাজ করছে। তাই আমরা অতীতে ফিরে যেতে চাই যেখানে সকল মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল। সেখানে সংস্কৃতিতে কোনো রাজনৈতিক আগ্রাসন ছিল না।’
এর আগে, গত ২৩ মার্চ সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী।
এ নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনার মুখে ফারুকীকে পরে বলেন, ‘নাম নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত শোভাযাত্রার আয়োজক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নেবে।’
চারুকলা অনুষদ থেকে সংবাদ সম্মেলনের জন্য গত আটই এপ্রিল সাংবাদিকদের যে আমন্ত্রণপত্র দেওয়া হয়, সেখানে কেবল ‘শোভাযাত্রা’ শব্দটিই লেখা ছিল, মঙ্গল শোভাযাত্রা নয়।
এবারের শোভাযাত্রার মোটিফের মধ্যে ‘স্বৈরাচারের’ দৈত্যরূপের প্রতিকৃতি নিয়েও বেশ আলোচনা হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবয়ব অনুকরণে এটি বানানো হচ্ছে বলেও আলোচনা চলছে।
এছাড়া বড় আকৃতির ইলিশ মাছ, কাঠের বাঘ, শান্তির পায়রা, ঘোড়া, পাখি, পালকি, মুগ্ধর পানির বোতল, ইসরায়েলি বর্বরতার বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনের প্রতি সংহতি জানিয়ে তরমুজের ফালি, সুলতানি ও মুঘল আমলের মুখোশ, রঙিন চরকি, তালপেতার সেপাই, পটচিত্র ইত্যাদি থাকবে বলে আয়োজকরা জানিয়েছেন।
আয়োজকরা জানান, তরমুজ ফিলিস্তিনিদের কাছে ‘প্রতিরোধ ও অধ্যবসায়ের প্রতীক’। মূলত এটি তাদের পতাকা বোঝাতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এর কারণ হলো, ফলটির বাইরের অংশের রঙ সবুজ। আর ভেতরের অংশগুলোর রঙ লাল, সাদা ও কালো। এ রঙগুলো ফিলিস্তিনের পতাকার রঙের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ।
তাই এবারের শোভাযাত্রায় অন্যান্য মোটিফের পাশাপাশি ফিলিস্তিনিদের সংগ্রামের সাথে সংহতি জানিয়ে তাদের প্রতীক হিসেবে তরমুজের মোটিফ রাখা হচ্ছে।
১৯৮৯ সাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ পয়লা বৈশাখে শোভাযাত্রা করে আসছে। শুরুতে এর নাম ছিল ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’। নব্বইয়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের পটভূমিতে অমঙ্গলকে দূর করে মঙ্গলের আহ্বান জানিয়ে শোভাযাত্রার নামকরণ হয় ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’।
প্রত্যেক বছর পহেলা বৈশাখে রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের সামনে থেকে এই শোভাযাত্রা বের হয়। সেখানে বিভিন্ন প্রতিকৃতি শোভা পায়, ঢাক-বাদ্য বাজিয়ে শোভাযাত্রাটি শাহবাগ মোড় হয়ে শিশুপার্কের সামনে দিয়ে ঘুরে ফের শাহবাগ হয়ে টিএসসিতে গিয়ে শেষ হয়।
জাতিসংঘের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর মঙ্গল শোভাযাত্রাকে বিশ্বের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত করে। তবে এবারের শোভাযাত্রা চারুকলার সামনে থেকে শুরু হয়ে শাহবাগ গোলচত্বর ঘুরে টিএসসিতে রাজু ভাস্কর্জ ডানে রেখে শহীদ মিনার, শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্র, দোয়েল চত্বর হয়ে বাংলা একাডেমির সামনে দিয়ে আবার চারুকলায় এসে শোভাযাত্রা শেষ হবে বলে আয়োজক কমিটি জানিয়েছে।
সেখানে সমতল, পাহাড়ি থেকে শুরু করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী, ব্যান্ড, বাউল, মূলধারার শিল্পীগোষ্ঠী, নারী ফুটবলার, ঘোড়ার গাড়ি, রিকশার র্যালি থাকবে। সেইসাথে সম্মুখভাগে পুলিশ বাহিনীর আটটি সুসজ্জিত ঘোড়ার সারি থাকবে।
র্যালি চলাকালে বাংলা মোটর, বারডেম হাসপাতাল, আজিজ সুপার মার্কেট, মৎস্য ভবন এই চারটি রাস্তা বন্ধ থাকবে। নীলক্ষেত ও পলাশির পথ খোলা থাকবে। শোভাযাত্রা শেষে রাস্তা খুলে দেয়া হবে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী র্যালির দুই পাশে অবস্থান নেবে। পাশ দিয়ে ঢোকা বন্ধ থাকবে র্যালি চলাকালে নিরাপত্তা ও ভিড় নিয়ন্ত্রণে মেট্রোর টিএসসি স্টেশন বন্ধ রাখার কথা বলা হয়েছে। বিকেল ৫টার পর ক্যাম্পাসের প্রবেশ পথ বন্ধ হয়ে যাবে। শুধু বেরিয়ে যাওয়ার পথ খেলা থাকবে।
এবার পহেলা বৈশাখের শোভাযাত্রা আয়োজন নিয়ে চারুকলার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিরোধ সামনে আসে। গত ২৬ মার্চ চারুকলা অনুষদের ২৬তম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের (২০১৭-১৮ সেশন) নাম ব্যবহার করে গণমাধ্যমে একটি বিবৃতি পাঠানো হয় যাতে অভিযোগ করা হয়, ‘এবারের বৈশাখ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বৈশাখ’।
শিক্ষার্থীরা বিবৃতিতে উল্লেখ করেন, শোভাযাত্রার জন্য বানানো স্ট্রাকচারের ডিজাইন ও আইডিয়া (কাঠামোর নকশা ও ভাবনা) সম্পূর্ণ শিক্ষকদের দেওয়া, চারুকলার আপামর সাধারণ শিক্ষার্থী এর সঙ্গে কোনোভাবেই সংযুক্ত ও অবগত নয়। এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজনের সঙ্গে ওই ব্যাচের কোনো সম্পৃক্ততা নেই বলেও দাবি করা হয়।
তবে চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক আজহারুল ইসলাম শেখ এই বিবৃতিকে উদ্দেশ্যমূলক বলে অভিহিত করেন। ওই সময় তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘যারা এই বিবৃতি দিয়েছে তারা চারুকলার বর্তমান ছাত্র না, পাস করে গেছে।’
তিনি বলেন, ১৯৮৯ সাল থেকে বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকদের সবার অংশগ্রহণে মঙ্গলে শোভাযাত্রার আয়োজন করা হতো। ২০০৬ সাল থেকে একটি ব্যাচকে এই আয়োজনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তবে এবার চারুকলার সব শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মতামতের ভিত্তিতে আবারও সবাইকে সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
‘কোনো একটা পলিটিক্যাল ইনটেনশন থাকতে পার যারা এটা করেছে। যারা বিবৃতি দিয়েছে তাদের ব্যাচেরও তো অনেকে এসে কাজ করছে। তাহলে এটা কি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত না? বৃহত্তর রাষ্ট্রীয় প্রোগ্রামকে বিতর্কে ফেলে দেওয়ার মতো উদ্দেশ্যে এটা করছে সেটা বলতে পারি না?’ বলেন তিনি।